ভূমিকা
বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র মেরামত এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেই আলোচনার সূত্র ধরে প্রবাসী সংহতির পক্ষ থেকে আমরা প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে কিছু প্রস্তাব তুলতে চাই।
২০২৪ সালে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রবাসী সংখ্যা কত তা নিয়ে বিভিন্ন সরকারি -বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ রয়েছে। প্রতি বছরই প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায় এবং অনেকেই দেশে ফিরে আসেন। তাই বাংলাদেশের মোট প্রবাসী সংখ্যা কত তা সঠিক ভাবে নির্ণয় করা খুবই কঠিন।

সম্পূর্ণ আলোচনা দেখতে, ছবির উপর লিংকে ক্লিক করুন।
বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রকাশিত তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জার্নাল – এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় বিশ্বে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা ১ কোটি ৫৫ লাখ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি প্রবাসী সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) তথ্যমতে বাংলাদেশী প্রবাসীদের সংখ্যা ১ কোটি ৪৮ লাখের বেশি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ১ কোটি ৫৫ লাখ।
এই বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্যের কোঠায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময় ২০২১ সালে সেটা ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে তিন চালিকা শক্তি- কৃষি, তৈরি পোশাক খাত এবং রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। দেশের মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স থেকে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে পৃথিবীর শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশ।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ছিল ২. ৩৭ কোটি ডলার। ২০০০ সালে তা বেড়ে ১৯৫ কোটি ডলার ছুঁয়েছিল, বর্তমানে তা ২৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক দূর্যোগের মধ্যে প্রবাসীরা রেকর্ড ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। ২০২৩ এ মোট রেমিট্যান্স এসছিল ২১.৯ বিলিয়ন। ২০২৪ এর গত ১০ মাসেই এসছে ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স, বছরের শেষ নাগাদ আমরা আবারও রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পেতে পারি।।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের অবদান জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশেরও বেশি। রেমিট্যান্সের কল্যাণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্য এবং মুদ্রার মান নির্ধারিত জায়গায় থাকছে। বর্তমানে শুধু রেমিট্যান্সের অর্থ দিয়েই ৬ মাসের দেশের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অর্থাৎ, প্রতিবছর দেশে যে পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ আসে, তার ১০ থেকে ১৫ গুণ প্রবাসীরা পাঠায়। উল্লেখ্য, ২০ বছর আগেও বাজেট করতে সরকারকে বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হতো।
প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে ২০২১ সালে পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। সম্প্রতি প্রকাশিত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর প্রবাসী আয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ‘অভিবাসন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে শীর্ষ ছয়ে থাকা দেশগুলো হলো- ভারত, মেক্সিকো, চিন, ফিলিপাইন, মিশর ও পাকিস্তান। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ৮ টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
২০১৫ সালের তালিকা অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে প্রবাসী জনগোষ্ঠীর (diaspora) তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। তালিকায় আমাদের উপরে আছে ভারত, চীন, মেহিকো এবং রুশ।বলা বাহুল্য এর সবগুলোই বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বড় দেশ। বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এটাই হয়ত আমাদের নিয়তি। প্রয়াত সমাজবিজ্ঞানী বোম্যান বলে গেছেন, “Today, every society is just a collection of diasporas…the connection between where you live and identity has been broken.”
জনসংখ্যার ঘনবসতি এবং কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে বাংলাদেশী ডায়াস্পরার আকৃতি ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। বাংলাদেশের রাজনীতি অর্থনীতিতে এদের প্রভাবও দিনদিন বাড়ছে, ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। কিন্তু দেশে অথবা বিদেশে প্রবাসী এ জনগোষ্ঠীকে সমন্বিত করার তেমন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কোন প্রচেষ্টা নাই। এখানে সেখানে দু’একটা সংগঠন হচ্ছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রম তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়, নেতৃত্বের লোভ, দলাদলি আর কামড়া-কামড়িই সার। আর আমাদের সরকার শুধু এদের পাঠানো রেমিট্যান্সে আগ্রহী, কেবল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমান কমে গেলে সেটা নিয়েই তাদের সভা-সেমিনার করতে দেখা যায়। সরকারের প্রবাসীদের জন্য কোন নীতি নেই, তাদেরকে দেশের সমাজ-সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার কোন উদ্যোগ নেই। এতোদিনেও প্রবাসীরা তাদের ভোটাধিকার পেল না, অবশ্য গত ১৫ বছর দেশে ভোটের সংস্কৃতিই ধ্বংসের পথে ছিল।
দেশের স্বার্থে প্রবাসী এবং দেশের বিনিময়টা দুদিকে হতে হবে, এটা সত্য যে দেশের নাগরিক হিসেবে দেশের জন্য সকল প্রবাসীর মনে একটা টান আছে। কিন্ত প্রবাসের ক্রুড়, কঠিন জীবনের অর্জন যদি দেশে গিয়ে খোয়াতে হয়, অথবা কোন উদ্যোগে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয় তবে আজকের বিশ্বায়নের এ যুগে ডায়াস্পরা সত্যিকার আগ্রহ সত্ত্বেও দেশের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে।
বর্তমান বিশ্বায়ন ও অভিবাসনের যুগে বেশি জনবলের দেশগুলোর উচিত ডায়াসপোরার মডেল অনুসরণ করা, যাতে প্রবাসীরা তাদের উৎস দেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
বাংলাদেশি প্রবাসীদের গন্তব্য ও উৎস সমূহ
বাংলাদেশ থেকে কর্মিরা পৃথিবীর অনেক দেশে বৈধভাবে কর্মসংস্থানের জন্য গিয়ে থাকেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা এবং পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান খুঁজে নেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারা নির্মাণ, গৃহস্থালী কাজ, এবং অন্যান্য বিভিন্ন অদক্ষ শ্রমের কাজে নিয়োজিত থাকেন। অন্যদিকে, ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক বাংলাদেশি শিক্ষিত পেশাজীবী হিসেবে আইটি, স্বাস্থ্যসেবা, এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কাজ করছেন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশীরা বিশ্বের ১৭২টি দেশে কাজ নিয়ে যায়। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে ৮-১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে যান। এদের বেশিরভাগই যান অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে তবে জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমিতির (বায়রা) দাবী অন্যান্য ভিসা মিলিয়ে বছরে ২০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যান।
বাংলাদেশ সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এরপরেই রয়েছে ওমান, কাতার, বাহরাইনের মত দেশগুলো। জর্ডান, সিঙ্গাপুর, রোমানিয়া এসব দেশেও অল্প কিছু করে কর্মী যাচ্ছেন। কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপ এক সময় বাংলাদেশের জন্য বড় শ্রমবাজার ছিল। এখনো এসব দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অনেক বাংলাদেশী কাজ করেন। বৈধভাবে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বলিভিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকেরা সম্প্রতি যেতে শুরু করেছেন বলে জানা যায়।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ- এই তিন মাসে প্রবাসে গেছেন ৩ লাখ তেইশ হাজার। এরমধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক কুমিল্লা থেকে। এই জেলা থেকে গেছেন ২৬ হাজার, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ হাজার জন গেছেন চট্টগ্রাম থেকে। তারপরে আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১৬ হাজার, টাঙ্গাইল ১৪ হাজার, এবং নোয়াখালী থেকে ১২ হাজার জন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবাসী আয় সম্পর্কিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সর্বদা চেষ্টা করেন। তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উৎসব, এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় বজায় রাখেন। এর মাধ্যমে তারা শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করেন না, বরং বিদেশিদের কাছেও বাংলাদেশের সংস্কৃতি পরিচিত করে তোলেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কর্মসংস্থান সুরক্ষা, সামাজিক স্বীকৃতি, এবং প্রায়শই কঠিন কাজের পরিবেশ। এছাড়াও, প্রবাসে বসবাসরত অনেকেই ভিসা ও অভিবাসন সংক্রান্ত জটিলতার মধ্যে পড়েন। অনেক প্রবাসী তাদের পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার কারণে মানসিক ও সামাজিক চাপের মুখে পড়েন।
জাতীয় পুনর্গঠনে প্রবাসীদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা
অন্যান্য পেশাজীবী শ্রেণির মত প্রবাসীদের সংগঠিত হওয়া ও রাজনীতি করার মৌলিক অধিকার আছে, আন্তদেশীয় চলাচল ও অবস্থানের বিশেষায়িত পরিস্থিতির কারণে তাদের বরং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়া আরও বেশি জরুরী।
বেশিরভাগ প্রবাসী বাংলাদেশী বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আওতাভুক্ত হয়ে মূলদলের বৈদেশিক শাখা খুলে তাদের লেজুড়বৃত্তি করে, নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে দেশের রাজনীতি ও ব্যবসাক্ষেত্রে সুবিধা আদায় করাকেই তাঁদের প্রবাসী রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলে মনে করেন। প্রবাসীদের স্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ এক্ষেত্রে কোন বিশেষ মনোযোগ পাচ্ছে না।
এছাড়াও জাতীয় পুনর্গঠনে দক্ষ, মেধাবী, অভিজ্ঞ বাংলাদেশী প্রবাসীদের কাজে লাগানোর যে বিশাল সুযোগ রয়েছে সেটি এসব রাজনৈতিক দলে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। জাতীয় পূনর্গঠন এবং নিজেদের স্বার্থ আদায়ে প্রবাসীদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও স্বতন্ত্র কর্মসূচী থাকা খুবই জরুরী।
এ ব্যাপারে কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারেঃ
১। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে গৃহীত Global Compact For Safe, Orderly, And Regular Migration এর ২৩ দফা কর্মসূচী অনুযায়ী নিরাপদ, নিয়মতান্ত্রিক ও নিয়মিত অভিবাসনের জন্য বাংলাদেশী প্রবাসীদের বিশ্বব্যাপী সংঘবদ্ধ করা।
২। নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও বেশি উপার্জনক্ষম অভিবাসন নিশ্চিত করতে অভিবাসন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত বাংলাদেশের সকল সরকারি-বেসরকারি অংশীজন সংস্থার সক্রিয়তা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
৩। অভিবাসনে ইচ্ছুক বাংলাদেশী শিক্ষার্থী/ পেশাজীবী/ শ্রমিকদের নির্ভরযোগ্য নেটওয়ার্ক হিশেবে পরামর্শ ও অন্যান্য সেবা দিয়ে সহায়তা করা।
৪। গন্তব্য দেশগুলোতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের নীতি-নির্ধারকদের স্বার্থে বাংলাদেশের স্বার্থে লবিং ও এডভোকেসি করা।
৫। জাতীয় পূনর্গঠনে মেধাবী- দক্ষ- দেশপ্রেমিক-উদ্যোক্তা- প্রবাসীদের যুক্ত করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।
৬। গ্লোবাল ফোরাম অন্য মাইগ্রেশান এন্ড ডেভেলপমেন্ট (জিএফএমডি) সহ প্রবাসীদের সকল আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম ও সিভিল সোসাইটির সাথে যৌথভাবে কাজ করা।
৭। গন্তব্য দেশগুলোতে অভিবাসন বিরোধী নীতিমালা ও আইনগুলোর প্রতিবাদে জনমত গড়ে তোলা ও বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেক দাবী-দাওয়া আছে যেগুলোর সমাধান হওয়া দরকার। ভোটাধিকার ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে প্রবাসীদের এই দাবীগুলো আলাপ-আলোচনার দাবী রাখে।
দাবীনামা
১) বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অধিকার রক্ষা করার লক্ষ্যে দুতাবসে পর্যাপ্ত জনবল, কার্যকরী কর্মপরিকল্পনা ও সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
২) বাংলাদেশের বিমানবন্দর ও দূতাবাসগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে ও অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।
৩) শ্রমশক্তি বা শ্রমসম্পদ রপ্তানি চুক্তির ক্ষেত্রে নিয়োগকারী দেশসমূহের অমানবিক বিভিন্ন দাবিদাওয়া রদ করতে দূতাবাসগুলোর সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে দূতাবাসগুলোকে প্রথমবার বিদেশ যাওয়া প্রবাসীদের কর্মক্ষেত্রে চুক্তির বিষয়ে অবগত থাকতে হবে যাতে চুক্তি ভঙ্গ করলে দূতাবাস কর্মীদের আইনী সহায়তা দিতে পারে।
৪) দ্বৈত নাগরিকত্ব আইনকে যুগোপযোগী করা এবং ‘ বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩’ অধিকতর প্রবাসী বান্ধব করে প্রবাসীদের আইনী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৫) শ্রমশক্তি রপ্তানির খাতকে দালাল ও প্রতারক চক্রের কবল থেকে উদ্ধার করে সরকারিভাবে স্বচ্ছতার সাথে পরিচালনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি (জিটুজি) প্রক্রিয়ায় দক্ষ অভিবাসী নিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জেলা পর্যায়ে জনশক্তি অফিসগুলোতে পর্যাপ্ত লোকবল নিশ্চিত করতে হবে।
৬) প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র, হালনাগাদ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তি ও প্রবাস থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে।
৭) প্রবাসে নির্যাতিত নারী শ্রমিক, নির্যাতিত কর্মচ্যূত শ্রমিকদের জন্য বিশেষ আইনী সহায়তা ও পূনর্বাসন করার ক্ষেত্রে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।
৮) প্রবাসী বাংলাদেশী দূর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহায়তা ও মরদেহ দেশে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করতে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভোটাধিকার
বাংলাদেশ সরকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের সুরক্ষা ও স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কনস্যুলার সেবা, আইনি সহায়তা, এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। এছাড়াও, সরকার প্রবাসী রেমিটেন্স বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা ও সুবিধা প্রদান করে থাকে।
সম্প্রতি প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি সংস্কারের অন্যতম পদক্ষেপ বলেও উল্লেখ করেন ‘সুজন’ এর বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করেছি। দেড় দুই কোটি প্রবাসী বাংলাদেশী—তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে যদি না পারি বা তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত না হয়, তাহলে বিরাট জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আমরা চেষ্টা করব, ওটা অনেক চ্যালেঞ্জিং।’ (Bonik Barta)
এতে বুঝা যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রবাসীদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, কিন্তু সরকারের মধ্যে এখনো দোনোমনা কাজ করতেছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে পোস্টাল ব্যালট এর মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা আছে কিন্তু সেটা খুবই জটিল এবং বেশিরভাগ প্রবাসী এর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
পোস্টাল ব্যালট কি এবং কিভাবে এর মাধ্যমে ভোট প্রদান করা যায়
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ২৭ ধারা অনুযায়ী, প্রযোজ্য ভোটাররা ডাক বিভাগের মাধ্যমে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে এমন অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
এই নিয়মের অন্তর্ভুক্ত নির্দিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠী যেমন- কারাবন্দি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা ব্যক্তি, প্রবাসী বাংলাদেশি, পোলিং অফিসার এবং যারা সশরীরে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে পারবেন না এমন ব্যক্তি।
এই প্রক্রিয়াটি প্রধানত তিনটি ধাপে বিভক্ত
১। ভোটার তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকার রিটার্নিং অফিসার বরাবর একটি দরখাস্ত করবেন তফসিল ঘোষণার ১৫ দিনের মধ্যে। এতে তাঁর পূর্ণ নাম, ডাক ঠিকানা, ভোটার আইডি নাম্বার ও ভোটার লিস্টের সিরিয়াল নাম্বার সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে।
২। দরখাস্ত যাচাই করে রিটার্নিং অফিসার একটি পোস্টাল ব্যালট ইস্যু করবেন এবং নির্ধারিত খামসহ ব্যালটটি ডাকযোগে আবেদনকারী ভোটারের নিকট প্রেরণ করবেন
৩। ভোটার ব্যালটবক্সে তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে চিহ্নিত করে প্রদত্ত খামে করে তাঁর ব্যালটটি পুনরায় পোস্ট অফিসের মাধ্যমে নির্বাচনী কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করবেন। উল্লেখ্য যে ফিরতি পোস্টটি নির্বাচনের ভোট গণনার শেষ হবার পূর্বেই রিটার্নিং কর্মকর্তার নিকট পৌঁছানো আবশ্যক
এবসেন্টি ব্যালট এবং প্রবাসীদের ভোট কিভাবে নেয়া যায় সে ব্যাপারে আমরা যেসব দেশে এসব সার্ভিস চালু আছে তাদেরকে অনুসরণ করতে পারি। বিশেষ করে তুরস্কের সিস্টেম আমাদের জন্য উপযুক্ত হতে পারে। তুরস্ক দীর্ঘকাল ধরে প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা করে আসছে। আমেরিকার উদাহরণও এক্ষেত্রে আমাদের কাজে আসতে পারে।
উপসংহার
২০২৪ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী সংখ্যা কত তার উপর বিভিন্ন রিসার্চ থেকে বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। তবে একটি বিষয়ে একমত হতে পারি, প্রতি বছরই প্রবাসীদের সংখ্যা ক্রমন্বয়ে বাড়ছে এবং সারা বিশ্বেই তারা নিজেদের উপস্থিতি ও অবদান রেখে চলেছেন।
ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রবাসীদের জাতীয় রাজনীতিতে সমন্বিত যাবে, এটি তাঁদের একটি শক্তিশালী গ্রুপ/ কমিউনিটি হিসাবে গড়ে তুলবে। এই লক্ষ্যে প্রবাসী সংগঠনগুলোর মধ্যে ভোটাধিকারের দাবীর পক্ষে ঐক্যমত্য গড়ে তুলতে হবে।
এই অধিকার অর্জন হলে প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষার পথ সুগম হবে। দেশ সংস্কারে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ আরও শক্তিশালী ও অর্থপূর্ণ হবে। প্রবাসীদের কঠোর পরিশ্রম ও অবদানের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সমাজ অনেক উপকৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাদের এই অবদান আরও প্রসারিত হবে বলে আশা করা যায়, এবং তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে আরো বেগবান করবেন এই প্রত্যাশা করছি।
মূল লেখক : নাজিম উদ্দিন
Leave a Reply