,

শোষণ, স্বীকৃতি ও নারীবাদঃ যৌনকর্ম নিয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও নারীবাদী প্রতিক্রিয়া*

যৌনকাজ (sex work) ঘিরে বিতর্ক একটি জটিল ও বহুমাত্রিক আলোচনা। এর মধ্যে রয়েছে এক পক্ষের নারীবাদী গোষ্ঠী, যারা যৌনকর্মকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক ধরনের শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেন—যেটি নারীদের উপর যৌন দাসত্ব ও সহিংসতা আরোপ করে এবং নারীর অধিকার লঙ্ঘন করে। অন্যদিকে, আরেক ধারার নারীবাদী চিন্তাধারা যৌনকাজকে একটি স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া পেশা হিসেবে দেখে, এবং যৌনকর্মীদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সামাজিক স্বীকৃতির  প্রশ্নে জোর দেয়। তারা দাবি করেন যে, যৌন কাজের অপরাধীকরণ যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা, এবং আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত করে। আমাদের দেশে যৌনকর্ম (sex industry) টিকে থাকার কারণ কি এ কর্মে নিয়োজিত নারীদের ব্যক্তিগত এজেন্সি? বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট কি এই দাবিকে সমর্থন করে? যদি না করে, তাহলে কেন যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠছে—যেখানে স্পষ্টভাবেই যৌনকর্ম পুঁজিবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক শ্রেণি শোষণের একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে? এই প্রবন্ধে ২০২৫ সালের নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশের একটি সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে যৌনকর্মের পেশাভিত্তিক স্বীকৃতি শ্রেণি হিসেবে পুরুষ ও পুঁজিপতিদের ক্ষমতাকে আর শক্তিশালী করে। যেখানে পুরুষদের নারীদের উপর ক্ষমতাধর অবস্থানকে ভিন্ন উপায়ে চালু রাখা হয়। এই ব্যবস্থার মধ্যে নারীর দেহকে এমনভাবে দেখা ও ব্যবহার করা হয় যেন নারীর শরীর পুরুষদের ভোগের জন্য, বা তাদের ব্যবহারের জন্য, তাদের আনন্দের জন্য। এখানে পুরুষদের ইচ্ছা নারীদের কল্যাণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়।

 অনেক সময় পুরুষেরা যৌনকর্মী ভাড়া করে এমন কাজ করতে যা তারা নিজেদের স্ত্রী বা প্রেমিকাদের সঙ্গে করতে পারে না। এর ফলে একটি নির্যাতনযোগ্য নারীবর্গ সৃষ্টি হয় যে নারীবর্গের সৃষ্টি অন্যান্য নারীদের জীবনের মর্যাদার জন্যেও নেতিবাচক সামাজিক মাপকাঠি নির্মাণ করে। এই মাপকাঠিতে সমাজের সকল নারীর জন্যেও এই ধারনা নির্ধারিত হয় যেন নারী মাত্রই  পুরুষের আনন্দ ও ব্যবহারের বিষয়। ফলে নারীরা জনপরিরে যখন কাজ করে, চলাফেরা করে, যৌনকর্মের  ভোক্তা পুরুষ সেসকল নারীদেরকেও উন্মুক্ত বস্তু হিসেবে গন্য করতে চায়। এই শ্রেনির পুরুষই মনে করে যেকোন নারীর গা ছোঁয়া যায়, দেখা যায়, কটুক্তি করা যায়, যৌন ব্যবহার করা যায়।

 এই যৌনকর্ম পুরুষদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলে, যাতে  নারী মানে এমন যে তাদের দেখলেই  তারা একপ্রকার যৌন উত্তেজনা অনুভব করে। যেহেতু যৌনতা সে টাকায় কিনতে পারে, আর তাই যৌন সম্পর্ককে আর তারা  নারী ও পুরুষের পবিত্র বন্ধন হিসেবে চিন্তা করতে পারেনা। ব্যক্তিগত জীবনেও এই পুরুষেরা নিজেদের সঙ্গীদের সাথে প্রতিশ্রুতি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। একদিকে যৌনকর্মকে পেশা স্বীকৃতি দিয়ে ভোক্তা হিসেবে এই পুরুষদের কাছে  নারীদের শরীর টাকার বিনিময়ে ছুঁয়ে দেওয়া যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এর ফলে এই পুরুষেরা   নারীদেরকে সমাজে নীচু অবস্থানে থাকা ব্যক্তি হিসেবে  গন্য করে। এই পুরুষতো সেই যৌনপল্লীতে জীবন কাটায় না, তাদের সাথে সমাজের অন্যান্য নারীদের চলতে হয়, কাজ করতে হয়। যৌনকর্মীদের এজেন্সির বাইরে এই  পুরো প্রক্রিয়ায় পুরুষদের যে ক্ষমতার ম্যানুপুলেশন করতে দেওয়া হয় তার প্রভাব পুরো সমাজে বিস্তার করেএর ফলে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক মানদণ্ড ও মিথ আরও দৃঢ় হয়, যা নারীদের অসম সামাজিক অবস্থানকে টিকিয়ে রাখে। তাছাড়া এখানে যৌনকর্মী নারীদের সাথে অন্যান্য নারীর যে শ্রেণি-বিভাজন তাও আরো পাকাপোক্ত হয়।

এছাড়া প্রতিবেদনটি যৌন কাজ’ (sex work) শব্দটিকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি। ফলে নারীর দেহকে পন্য করে একদল নারী যারা বিভিন্নভাবে অন্যের টাকা আত্মসাৎ করে, সেই শ্রেনীর কাজকেও কি তাহলে যৌনকর্ম বলা হবে তার উত্তর মিলে না।  যে এজেন্সির কথা বলে যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হল তার নেতিবাচক প্রভাব সমাজে দেখা যাবে।

সমর্থনকারী নারীবাদী গোষ্ঠী যারা যৌনকর্মীদের সুরক্ষার পক্ষে মানবাধিকারভিত্তিক ভাষা ব্যবহার করেন এবং যৌন কাজকে বৈধতা দেওয়ার পক্ষপাতী অবস্থান নেন তারা আসলে, যৌন কাজ কাঠামোগতভাবে নারীদের শরীরের শোষণ হিসেবে আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে কীভাবে কাজ করে সেটিকে অস্বীকার করেন।  ঐতিহাসিকভাবে নারীর যৌনকর্ম নিয়ে যে উদাহরন  তারা নিয়ে আসেন, সেগুলো দিয়ে সমসাময়িক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না।প্রাক-ঔপনিবেশিক বিশেষত মুঘল যুগে, (courtesan) তাওইফদের যে মর্যাদা ও ক্ষমতা ছিল সে ঐতিহাসিক বাস্তবতার বহুকাল পেড়িয়ে সমাজ এক ভিন্নবাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। এর সাথে এও স্মরণ  করা জরুরি   তাওইফদের যেভাবে যৌনকর্মী বলে প্রচার করা হয় তাদের সামাজিক ইতিহাস এর ভিন্ন কথা বলে। তারা সমাজে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় নারী ছিলেন যারা সঙ্গীত, কবিতা এবং নৃত্যের মতো শিল্পকলায় পারদর্শী ছিলেন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতেন। সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতায় এখনকার সময়ে  যৌনকাজ বা অর্থমূল্য বিনিময়ে যৌন সম্পর্ক আদান-প্রদান কি প্রকৃতপক্ষে সে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে কোনভাবে তুলে ধরে?  বরং এ সময়ে যে যৌন কাজ মূলত সহিংস, এবং এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, পুরুষ কর্তৃত্ব এবং নারীর উপর দেহগত ও মানসিক শোষণের একটি রূপ। নারীর যৌনতা ও যৌন শক্তিকে দখল করে নেয় সেই পুরুষেরা যারা যৌন বিনিময়ের ক্রেতা অথবা নিয়ন্ত্রক (যেমন যৌনকর্মের দালালশ্রেনী)।  এই অবস্থার ভিত্তিতে যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করছি।

যৌনসেবা বা পতিতাবৃত্তির যে বাজার তা আমাদের সমাজে তা  বিভিন্ন কারনে  নারীদের জন্য ক্ষতিকর। যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এই লিবারাল ফেমিনিজম আমাদের সমাজের জন্যে খাটে না? অন্যান্য নারীদের জীবন আচরন যৌনকর্মীদের জীবনকেও প্রভাবিত করে। এজেন্সির কথা বলে যৌনকর্মকে পেশা বলে প্রতিষ্ঠিত করলে পর্ণগ্রাফি নিয়ে কী করবেন?  আমার কাছে মনে হয় আমাদের সমাজ বাস্তবতার বাইরে লিবারাল নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে নারীবাদ জনবিচ্ছিন নারীবাদ থেকে যাবে। যা আমাদের কাম্য নয়।  নারীবাদ কি শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক নারীর জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি এটিকে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে গড়ে তোলা হবে — এই প্রশ্নটি ভাবার সময় এসেছে। যদি আপনি নারীবাদকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে চান, তাহলে কিছু বিষয় নতুনভাবে বিবেচনা করতে হবে। এই পুনর্মূল্যায়নের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়ন তখনই অর্থবহ হবে, যখন তাদের মুক্তির চেতনাকে সামনে রেখে পেশার নিরাপত্তা নয়, বরং শোষণমুক্ত একটি জীবন নিশ্চিত করা যাবে। কেবল পেশাকে টিকিয়ে রেখে নয়, বরং তাদের জীবনের জন্য চলমান সংগ্রামকে সহানুভূতির সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে। কোনো ধরনের অপরাধীকরণ ছাড়াই, তাদের জীবনের মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা ইতিমধ্যে যৌন পেশায় জড়িত, তাদের অপরাধী হিসেবে দেখার পরিবর্তে তাদের জন্য সম্মানজনক ও বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করা জরুরি।

.

One response to “শোষণ, স্বীকৃতি ও নারীবাদঃ যৌনকর্ম নিয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও নারীবাদী প্রতিক্রিয়া*”

  1. Sayema Khatun Avatar
    Sayema Khatun

    যৌন সম্পর্ক চর্চার সামাজিক সাংস্কৃতিক গভীর জটিল বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করে লেখাটা খুব দরকারি এবং সঠিক সময়ে উত্থাপিত হয়েছে। নিগার সুলাতানাকে ধন্যবাদ এই বিশ্লেষণ হাজির করবর জন্যে।

Leave a Reply